"হাট-বাজার" বা সাপ্তাহিক/পাক্ষিক বাজার বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীনকালে, বিভিন্ন স্থানের কারিগর ও বাণিজ্যীরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেন এবং এক বা দুই দিনের জন্য তাদের পণ্য বিক্রি করতেন, এরপর দ্রুত পরবর্তী হাটে চলে যেতেন। সাধারণত, এই বাজারগুলোর তৈরি ও ভাঙা এত দ্রুততার সাথে হত যে, তাদের উপস্থিতি ও চলে যাওয়ার বর্ণনা শুনলে অবাক হতে হয়, এবং এখনো এটি দেখতে বেশ চমকপ্রদ।
বর্তমান যুগে, যেখানে শহরাঞ্চলে ইটের তৈরি দোকান, শপিং মল এবং অনলাইন শপিংয়ের প্রাচুর্য, সেখানকার ক্রেতাদের জন্য পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। কিন্তু তবুও, ঐতিহ্যবাহী হাটগুলোর গুরুত্ব অব্যাহত রয়েছে, এবং অনেক শহরে বসবাসরত মানুষ এই হাটগুলোর তীব্র সরগরম এবং উত্তেজনার ব্যাপারে অজ্ঞাত। এই হাটগুলো এখনো বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু এবং ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে কাজ করছে।
অবশ্যই, বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী হাট ছিল, তবে কিছু হাট এমন রয়েছে যেগুলোর পরিচিতি শুধু সেই অঞ্চলের বাইরে থেকেও ব্যাপক।
টাঙ্গাইল এবং পাবনার তাঁত হাট
তাঁত বা হস্তশিল্পে বোনা কাপড় গ্রামীণ বাংলার জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিল। এই হাটগুলোতে বর্ণিল রঙের শাড়ি, গামছা, লুঙ্গি বিক্রি করা হত। টাঙ্গাইলের বাবুরহাট ও কোরটিয়া হাট ২০০ বছরের বেশি পুরোনো, যেখানে টাঙ্গাইলের বিখ্যাত টান্ট শাড়ি বিক্রি হত। কোরটিয়া হাটটি পন্নি জমিদাররা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে টাঙ্গাইল হাটে জামদানি, বেনারসি এবং টান্ট শাড়ির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের বিক্রিও চলে।
চাঁদপুর মাছ হাট
বাংলাদেশি রান্নার অন্যতম প্রধান উপাদান হল ভাত এবং মাছ। তাই চাঁদপুরের মাছের বাজার এত বিখ্যাত, কারণ এটি দেশের বৃহত্তম নদী সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এবং এখান থেকে প্রতিদিন তাজা মাছ বিক্রি হয়ে দেশের নানা প্রান্তে চলে যায়।
রাজশাহীর আম হাট
আম বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফল, এবং রাজশাহী অঞ্চলের আম বিশেষভাবে বিখ্যাত। বানেশ্বরে দেশের অন্যতম বৃহত্তম আম বাজার রয়েছে, যেখানে হাজার হাজার টন আম প্রতিদিন কেনাবেচা হয়।
মুন্সিগঞ্জের কাঠের বাড়ি
মুন্সিগঞ্জের লৌহাজাং হাটে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি ছোট ছোট ঘর বিক্রি করা হয়। এই বাড়িগুলো নদী ভাঙনের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য তৈরি করা হয়, যাতে সহজেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো যায়।
রাঙামাটির বনরূপা হাট
রাঙামাটির বনরূপা হাটে বিভিন্ন ধরনের মুষ্টিযন্ত্র, শাকসবজি, ফলমূল ও পাহাড়ি দ্রব্য পাওয়া যায়। এখানকার অনেক পণ্য শহরের মানুষদের জন্য অপরিচিত এবং বিশেষভাবে সংগ্রহ করা হয়।
মানিকগঞ্জের নৌকা হাট
বাংলাদেশের নদীভিত্তিক জীবনযাত্রায় নৌকা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানিকগঞ্জের ঘিওর হাটে বিভিন্ন ধরনের নৌকা কেনাবেচা করা হয়।
বরিশালের পেয়ারাবাজার
বরিশালের ভিমরুলি এলাকায় গাছ থেকে পেয়ারার বাজার একটি ভেসে চলা বাজার হিসেবে পরিচিত। এখানে স্থানীয় গাঁয়ের ২৬টি গ্রাম থেকে তাজা পেয়ারা বিক্রি হয়।
ডেমরার জামদানি হাট
ঢাকার কাছে ডেমরা এলাকায় জামদানি শাড়ির বৃহত্তম হাট রয়েছে। এখানে প্রতি শুক্রবার সকাল ৫টা থেকে ৮টা পর্যন্ত জামদানি শাড়ির কেনাবেচা হয়।
এছাড়া বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে আরও অনেক হাট রয়েছে, যেগুলো স্থানীয় পণ্যের বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। কিছু হাট এখনো বেঁচে আছে, যেমন কোরটিয়া, আতাইকুলা, সিরাজগঞ্জ, ঘিওর, মুন্সিগঞ্জ, যা স্থানীয় ঐতিহ্য ও বাণিজ্য জীবন্ত রাখছে।